ঢাকা , বুধবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২৫ , ২ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

​বাড়তি দামে দিশেহারা মানুষ

রংপুরে মজুত করা চালের কেজিতেও বাড়ল ৮-১০ টাকা

স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় : ১৪-০১-২০২৫ ০৩:৫৩:৩৩ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ১৪-০১-২০২৫ ০৪:০০:৫৪ অপরাহ্ন
রংপুরে মজুত করা চালের কেজিতেও বাড়ল ৮-১০ টাকা ​সংবাদচিত্র : সংগৃহীত
শস্যভাণ্ডার খ্যাত রংপুরে এখন আমনের ভরা মৌসুম। এর মধ্যেই পাইকারি ও খুচরাতে চালের দাম বেড়েছে। গত ১৫ দিনে বস্তাপ্রতি ৩৫০-৪০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এতে খুচরা পর্যায়ে চিকন চালের দাম কেজিতে সাত-আট টাকা এবং মোটা ও মাঝারি চালের দাম আট-দশ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। তার মধ্যে আগের কেনা মজুতকৃত চালের কেজিতেও আট-দশ দাম বাড়িয়েছেন আড়তদাররা।

খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতারা বলছেন, মিল পর্যায়ে চালের দাম বেড়েছে। এর প্রভাবেই খুচরা ও পাইকারিতে দাম বেড়েছে। বেশি দামে কিনতে হওয়ায় বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের। মিল মালিকদের দাবি, আমনের ভরা মৌসুমে ধানের দাম বাড়ায় চালের দাম বাড়িয়েছেন। বেশি দামে ধান কিনে চাল করতে উৎপাদন খরচ বেশি পড়ায় প্রতি বস্তায় ২৫০-৩০০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়েছেন তারা। সেটি খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতারা ৩৫০-৪০০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে বিক্রি করছেন। ফলে খুচরাতেও দাম বেড়েছে।   

পাইকারি ব্যবসায়ী ও মিল মালিকরা দাম বাড়ানোর কারণ দেখালেও বাস্তবতা হলো দাম বাড়ায় ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষজন। অনেকের মোটা চাল কিনতে কষ্ট হচ্ছে বলে জানিয়েছেন। গত রবিবার জেলার বড় দুটি পাইকারি মোকাম ও দুটি বাজার ঘুরে ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

বিপাকে নিম্নআয়ের মানুষ
চাল কিনতে বাজারে আসা সাধারণ মানুষজন বলছেন, মিল ও আড়তগুলোতে হাজার হাজার বস্তা চাল মজুত থাকলেও দাম বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। মিল মালিক ও আড়তদাররা সিন্ডিকেট করে কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে দাম বাড়িয়ে গত ১৫ দিনে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। দাম বাড়ায় স্বল্পআয়ের মানুষজন বিশেষ করে শ্রমজীবী, কৃষিজীবী ও দিনমজুরসহ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো ভোগান্তিতে পড়েছেন। আবার নিম্নবিত্তের মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে দাম। এখন মোটা চাল কিনতেও কষ্ট হচ্ছে তাদের। কষ্টের কথা জানিয়ে নগরের রিকশাচালক মো. শাহজাহান আলী ও দিনমজুর নবাব আলী জানান, তাদের আয় বাড়েনি। অথচ চালের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। ৪২ টাকার মোটা চাল ৫০-৫২ টাকায় কিনতে হচ্ছে। ফলে তিন বেলার পরিবর্তে দুই বেলা খেতে হচ্ছে তাদের। একই ভোগান্তির কথা কথা জানালেন গৃহবধূ আঞ্জু বেগম। তিনি বলেন, ‘যেভাবে চালের দাম বেড়েছে, তা অবিশ্বাস্য। সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে উঠেছে। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

কত বেড়েছে কেজিতে
বিভাগের অন্যতম বড় চালের মোকাম রংপুর সিটি বাজার ও মাহিগঞ্জ মোকামে গিয়ে দেখা গেছে, ৫০ কেজির প্রতি বস্তা চালে ৩০০-৪০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ফলে পাইকারিতে ১৫ দিনের আগের ৪২ টাকার মোটা চাল এখন ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি ৭০ টাকার নাজিরশাইল বেড়ে ৮০, কাটারিভোগ ৭২ থেকে ৮২, মিনিকেট ৭০ থেকে ৭৮, জিরাশাইল ৬৪ থেকে ৬৮, বিআর ৫৬ থেকে ৬৪, গুটি স্বর্ণা ৫০ থেকে বেড়ে ৫৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এই হিসাবে নাজিরশাইলের বস্তায় বেড়েছে ৫০০ টাকা। এই দামে দুই মোকাম থেকে পাঁচ-১০ কেজি করে চাল কেনা যাচ্ছে। তবে খুচরা বাজারে কেজিতে দুই টাকা করে বেড়েছে।

ধানের দাম বাড়ার অজুহাত
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে এক অটোরাইস মিলের স্বত্বাধিকারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এখন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ধান মজুত করে রেখেছেন। তারা বাড়তি দাম না পেলে ধান ছাড়ছেন না। ফলে তাদের কাছ থেকে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। আমাদেরও খরচ আছে। এ কারণে বেশি দামে চাল বিক্রি করতে হচ্ছে। তবে আমরা বস্তায় ২৫০-৩০০ টাকা বাড়ালেও আড়তদার ও পাইকারি বিক্রেতারা ৩৫০-৪০০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে বিক্রি করছেন। সেটি আবার খুচরা বাজারে দুই-তিন টাকা কেজিতে বেড়ে যাচ্ছে।’

মজুত থাকা সত্ত্বেও বলা হচ্ছে সংকট
সিটি বাজার ও মাহিগঞ্জ মোকামের আড়তদাররা বলছেন, মিল মালিকরা হাজার হাজার বস্তা চাল মজুত রেখে কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে চালের দাম বাড়িয়েছেন। আবার বলছেন ধানের দাম বেড়েছে। এজন্য দাম বাড়িয়েছেন। ফলে তাদের কাছ থেকে বেশি দামে কিনে বেশিতে বিক্রি করছেন আড়তদাররা। তবে সরেজমিনে সিটি বাজার ও মাহিগঞ্জ মোকামেও কয়েক হাজার বস্তা চালের মজুত দেখা গেছে। এর মধ্যে আগের কেনা চালের দামও বাড়িয়েছেন আড়তদাররা। কেন মজুতকৃত চালের বাড়িয়েছেন, তার জবাব দেননি কেউ। এ নিয়ে কথা বলতে চাইলেও কোনও আড়তদার বক্তব্য দিতে রাজি হননি।

বেড়েছে মজুত করা চালের দামও
সিটি বাজারের আফজাল ট্রেডার্সে গিয়ে মালিক আফজাল হোসেনকে পাওয়া না গেলেও ব্যবস্থাপক আফজাল শরীফ বলেন, ‘গত এক মাস ধরে আমাদের গোডাউনে দুই হাজারের বেশি বস্তা চাল মজুত ছিল। এর মধ্যে হাজার খানেক বস্তা বিক্রি হয়েছে। পরে বেশি দামে এক হাজার বস্তার মতো কিনেছি।’ কিন্তু আগের মজুত করা চালের দাম কেন বাড়িয়েছেন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সবাই বাড়িয়েছে, তাই।’আরেক আড়তের ব্যবস্থাপক সাহেব আলী বলেন, ‘আমাদের গোডাউনে দুই হাজার বস্তা চাল সবসময় মজুত থাকে। জেলায় এবং বিভাগের বিভিন্ন জেলায় পাইকারিতে বিক্রি করা হয়।’

আগে কম দামে কিনে মজুতকৃত চালের দাম কেন কেজিতে আট-দশ টাকা বাড়িয়েছেন জানতে চাইলে সাহেব আলী বলেন, ‘বড় বড় মোকামে দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদেরও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।’ মজুত রাখা বেআইনি তারপরও কেন রাখা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের মালিকের আদেশ। এখানে আমরা কর্মচারী। আমাদের যেভাবে বলা হয়, আমরা সেভাবে করি।’

একইভাবে মাহিগঞ্জের অন্তত ৫০টি আড়তে ৩০-৪০ হাজার বস্তা আগের কেনা চাল মজুত আছে বলে জানিয়েছেন আড়তদারের দুজন ব্যবস্থাপক। তারা জানিয়েছেন, সংকট দেখিয়ে গত ১৫ দিনে আগের কেনা চাল দিয়ে কয়েক কোটি টাকা লাভ করেছেন তারা। একই কথা বলেছেন পাইকারি চাল ব্যবসায়ীরাও।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাহিগঞ্জের মোকামের এক আড়তদার জানিয়েছেন, প্রত্যেক আড়তে অন্তত এক হাজার থেকে দুই হাজার বস্তা পর্যন্ত চাল মজুত থাকে। মিল পর্যায়ে দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মজুত করা চালের দাম বাড়িয়েছেন আড়তদাররা। কেউ কম দামে বিক্রি করতে চাইলেও সে সুযোগ নেই। কারণ সব আড়তে একই দামে বিক্রি করাই ব্যবসায়ীদের অঘোষিত সিদ্ধান্ত।

উদ্বৃত্ত থাকবে আড়াই লাখ মেট্রিক টনের বেশি চাল
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর রংপুরের উপপরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন বলেন, ‘রংপুর বিভাগে সবসময় ধান ও চাল উদ্বৃত্ত থাকে। প্রতি বছর জেলা থেকে উৎপাদিত সাড়ে চার লাখ মেট্রিক টন চাল দেশের অন্যান্য জেলার চাহিদা মিটিয়ে থাকে। ফলে এখানে ধান কিংবা চালের সংকট বলা অযৌক্তিক।’আমনের মৌসুম শেষে নতুন ধানের চাল পুরোদমে বাজারে এসেছে জানিয়ে রিয়াজ উদ্দিন বলেন, ‘চলতি আমন মৌসুমে রংপুরে ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ৬৬ হাজার ৭২৩ হেক্টর জমি। সেখানে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে চাষ হয়েছে এক লাখ ৬৬ হাজার ৯৪০ হেক্টর। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ ৯৮ হাজার ৪৪ মেট্রিক টন চাল। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্যে জেলার মানুষের চালের চাহিদা রয়েছে সাড়ে তিন লাখ মেট্রিক টন। হিসাবে আড়াই লাখ মেট্রিক টনের বেশি উদ্বৃত্ত থাকবে। যা দেশের বিভিন্ন জেলার চাহিদা মেটাবে। সেখানে ভরা মৌসুমে রংপুরে চালের দাম বাড়ানোর কোনও কারণ দেখছি না। এটি সিন্ডিকেটের কারসাজি। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।’

সিন্ডিকেটের হাত
মূলত মিল মালিক ও আড়তদাররা সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়িয়েছেন বলে জানালেন রংপুরের কৃষি বিশেষজ্ঞ কৃষিবিদ আলী আযম। তিনি বলেন, ‘চালের বাজার অস্থির করার পেছনে কয়েকজন মিল মালিক, আড়তদার ও ব্যবসায়ী জড়িত। রংপুর চাল উৎপাদনে দেশের অন্যতম উদ্বৃত্ত এলাকা। সেখানে ভরা মৌসুমে চালের দাম অস্বাভাবিক বাড়ানোর পেছনে সিন্ডিকেটের হাত রয়েছে। সরকারের দায়িত্বশীলদের উচিত, প্রত্যেক আড়ত ও মিলে অভিযান চালিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা।’

বাংলা স্কুপ/ প্রতিনিধি/ এনআইএন/এসকে


প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ